জীবনে একবার প্রেমে পড়লে সারা জীবন কলুর বলদের মতো সংসারের ঘানি টানতে হয়। অন্তত প্রথম প্রেমেই যদি আপনি বাজিমাত করতে পারেন। কিন্তু সেই সৌভাগ্য যে সকলের হয় তা নয়। যাদের হয় না। তারা ভাগ্যবান। জীবনে বারবার প্রেমে পড়ার সিংহদূয়ার উন্মুক্ত থাকে তাদের জন্য। তাই আমি বারবার প্রেমে পড়ি। প্রতিটি নতুন প্রেম এক একটি নতুন জীবনের স্বাদ নিয়ে উপস্থিত হয়। মাসিক ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনার কাজে কত মহিলা কবি লেখিকার সাথেই তো আলাপ হয়। সকলেই কি প্রেমে পড়ার মতোন? তা নিশ্চয় নয়। বয়সের তারতম্য। সংস্কৃতির তারতম্য। হ্যাঁ আমার স্বীকার করতে অসুবিধা নাই। আমি সুন্দরী ললনাদের প্রতি একটু বেশি দুর্বল। না, তাই বলে কবিতা নির্বাচনে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট নই। একদমই। অনেক সুন্দরী রূপসী লেখিকাই সেই সাক্ষ্য দেবেন আশা করি। অন্তত প্রায় এক দশক ব্যাপী পত্রিকা সম্পাদনার কাজে এই বিষয়ে আমার একটিই পরিচয় পত্রিকা সম্পদক। তো সেই সম্পাদনার কাজেই দীপাবলীকে ইনবক্সে মেসেজ করেছিলাম। তিনটি নতুন কবিতা চেয়ে। তার আগে দীপাবলীরর কবিতা কখনো প্রকাশিত হয় নি আমাদের পত্রিকায়। হয়তো কোন মিউচ্যুয়াল বন্ধুর ওয়ালে দীপাবলীর কবিতার লাইন আমাকে প্রলুব্ধ করেছিল তার কাছ থেকে কবিতা নেওয়ার বিষয়ে। এইভাবেই সম্পাদনার কাজ এগিয়ে চলতে থাকে। নতুন নতুন লেখক লেখিকার সাথে যোগাযোগের রাজপথ প্রশস্ত হতে থাকে। সম্পাদনার কাজে জড়িত ব্যক্তি মাত্রেই জানেন সেকথা। নতুন কিছু নয়।
নতুন যেটা সেটা হলো, দীপাবলীর প্রেমে পড়ে যাওয়াটা। একেবারে যাকে বলে প্রথম শ্রবণেই প্রেম। বয়স তো কম হলো না। তিন কুড়ির কাছাকাছি। প্রেমের প্রথম ফোটা কুঁড়ির পর কয়েক যুগ চলে গিয়েছে। এখন অভিজ্ঞতার ঝুলি বেশ ভারী। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হলো কই। কবিতা দেওয়া নেওয়ার পর্ব শেষ হতেই দীপাবলীর মেসেজ। সম্পাদকের পরিচয় জানতে চাই। না। সম্পাদকের পরিচয়ের বাইরে আমি সাধারণতো লেখক লেখিকাদের সাথে ব্যক্তি পরিচয়ের বিষয়ে আগ্রহী নই। সেটা আমার ফেসবুক আইডির সকলেই জানেন। এবং কেউই তাতে অসন্তুষ্ট হন না। সম্পাদকের সাথে লেখক লেখিকারদের সম্পর্ক একটাই। লেখা দেওয়া নেওয়া ও পত্রিকায় প্রকাশ। তার বাইরে ব্যক্তিগত স্তরে পারস্পরিক জানাশোনার পরিধি বিস্তৃত করার মানে হয় না। তো সেই ভাবেই এড়িয়ে গেলাম। দীপাবলী মিত্রের আবেদন। বল্লামও সেই কথা। কিন্তু হলে হবে কি। পরের মেসেজ। সম্পাদকের একটি ছবি দেখতে চাই। কি মুশকিল। আমার প্রোফাইলে আমার পত্রিকার লোগো দেওয়া থাকে। নিজের ছবি থাকে না। সেটাই আমার নিয়ম। হটাৎ করে তার বাইরে যাবোই বা কেন আমি? সত্যই যেতে চাইও নি প্রথমে। বাহ! আপনি আমার কাছ থেকে কবিতা নেবেন। আমার প্রোফাইল ছবি নেবেন। আপনার পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। আর আমি জানতে পারবো না, কে আমার কাছ থেকে ছবি নিচ্ছে। লেখা নিচ্ছে। প্রকাশ করছে? এই রে। এতো খুবই ন্যায়সঙ্গত প্রশ্ন। ভাগ্য ভালো, এমন প্রশ্ন কেউ আগে করেনি। পরের মেসেজ। আপনি যে বসে বসে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে নেই। কি করে বুঝবো আমি? আর আমি আপনার ছবি চাইলে, পরিচয় জানতে চাইলেই দোষ? না না রাগ করবেন না। দোষের কথা তো বলি নি আমি। তবে এটা বুঝতে পারছি আপনার চোখদুটি যে খুবই সুন্দর সেটা নিয়ে আপনি বেশ গর্বিত। পাল্টা উত্তর। তবেই দেখুন। ঠিকই ধরেছি আমি। বেশ ডুবে ডুবে জল খাচ্ছেন। হ্যাঁ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ চট করে দৃষ্টি সরাতে পারে না। আর নিজের চোখকে কার না সুন্দর বলে মনে হয় বলুন তো। ঠিক কথা। দীপাবলী মিত্রের কথায় যুক্তির ফুলঝুড়ি।
পরের দিন সুপ্রভাত লেখা মেসেজ। ভদ্রতার খাতিরে উত্তর দিতেই হয়। কিন্তু এবার একটু সাবধানে। বেশি কথা না বলাই ভালো। কথায় কথা বাড়ে। এমনিতে ভদ্রমহিলার চোখ দুটি যে আহামরি রকমের কিছু, তা নয়। হলে তো আমিই আগ বাড়িয়ে আলাপ পরিচয় করতে ছুটতাম। কিন্তু সে চোখ অসুন্দরও নয়। বড়ো বড়ো দুটি চোখ। ঝকঝক দৃষ্টি। প্রোফাইল ছবিতে যতটুকু মালুম হয় আর কি। কিন্তু নিজের ব্যক্তি পরিচয় জাহির করতে একদমই ভালো লাগে না আমার। পত্রিকার কাজে সম্পাদকের একটিই পরিচয়। সেটি তার পেশাগত দক্ষতা ও সুন্দর ব্যবহার। এইদুটি ছাড়া দীর্ঘদিন নিয়মিত পত্রিকা চালানো সম্ভব নয়। যাইহোক, সারাদিন পরবর্তী সংখ্যার কাজে ব্যস্ত থাকায়, আর লগইন করা হয় নি। রাতে সব কাজ মিটিয়ে রোজকার মতো লগইন করে ঢুকেছি। ফুরফুরে মন। ঝরঝরে শরীর।
দীপাবলীর মেসেজ। না টেক্সট মেসেজ নয়। এ’যে একেবারে ভয়েস মেসেজ। ভয়েস মেসেজ সচারচর কেউই দেয় না। আমি তো কোনদিনই দিই না। কি আর করা, মাউস নিয়ে খুলতেই হলো সে গুপ্ত শব্দভাণ্ডার। ‘ও কি ও বন্ধু কাজল ভ্রমরারে, কোনদিন আসিবেন বন্ধু কয়্যা যাও কয়্যা যাওরে’। কি আর কইবো? আমি তো একবার শুনেই কাৎ। চিরদিনের গান পাগল মানুষ। আহা কি গলা! না অসামান্য অসাধারণ কিছু নয়। কিন্তু কি দরদী আর বড়ো আন্তরিক সে গলা। কোন বাজনার দৌরাত্ম নাই। দীপাবলী মিত্রের খোলা গলায় সেই আমার প্রথম ডুব দেওয়া। ‘বটবৃক্ষের ছায়া যেমন রে, মোহনবন্ধুর মায়া তেমন রে’। সত্যিই সেই গলার মায়ায় পড়ে গেলাম। কতবার যে শুনলাম তার ঠিক নাই। বিমুগ্ধ চিত্তে সেই কথা জানাতেই। পরের মেসেজ। আপনার আজকের লেখাটা পড়লাম। এত সুন্দর লেখেন আপনি। নিজের লেখার প্রশংসায় কার না মন গলে। তারপর এমন দরদী কন্ঠের সুন্দরী মহিলার কাছ থেকে সেই প্রশংসা এলে।
এরপর দুজনের আলাপ জমতে বেশি দেরি হলো না। দেরী হতে থাকলো রোজাকর রাতের ঘুম। তা হোক। যত কথা হয়। তত ভরে ওঠে প্রাণ। দুজনের পছন্দের বিষয়গুলির ভিতরে এত মিল! চিন্তা ভাবনার গতিপ্রকৃতি। ভালো লাগা মন্দ লাগা। প্রেমে পড়তে আর বেশি কি লাগে? কিন্তু দীপাবলী তখনো কিছুতেই ফোন করতে চান না। কতবার নম্বর জানতে চাই। এই ভাবে টেক্সট মেসেজ করে করে কত আর কথা বলা যায়? দীপাবলীর কথায়, এর ভিতরে আমাদের হারিয়ে যাওয়া প্রেমপত্রের যুগের একটা ছোঁয়া থেকে যায়। মন্দ নয় কথাটা। আমারও নেশা ধরতে থাকে। মধ্যরাতের সংলাপে দুজন যেন দুজনের কাছে প্রতিদিন একটু একটু করে উন্মুক্ত হতে থাকি। কবে যে কেটে গেছে এক সপ্তাহ। টের পাইনি।
এরপর একদিন, মঙ্গলবারের রাত। শ্রাবণের বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। ভিতরে দীপাবলীর মেসেজের অপেক্ষায়। কিন্তু তার দেখা নাই। দেখা নাই গত তিনদিন ধরেই। সারাদিনের কোন কাজেই মন লাগে না। কি হলো। কি ব্যাপার। বুঝতে পারছি না। দীপাবলীর মোহে জড়িয়ে পড়ছি পাকে পাকে। যদিও এই ভারচ্যুয়াল জগতের প্রেমের ভ্যালিডিটি খুব বেশি হয় এমনও নয়। তবু। তিন রাত ভালো ঘুমও হয় নি। হটাৎ চোখে পড়লো দীপাবলীর নামের পাশে সবুজ আলো জ্বলে উঠলো। জেগে উঠলাম আমিও। ইনবক্সে ক্লিক করলাম। কি ব্যাপার দীপাবলী? কি হয়েছে্? পুরো তিনদিন দেখা নাই? চিন্তায় কূলকিনারা নাই। উত্তর এলো তৎক্ষণাত। এইরে সম্পাদক মশাই কি প্রেমে পড়িলেন? হা হা। সে কথা থাক। তিনদিন দেখা পেলাম না যে? উত্তর দিই আমি। কিন্তু যে উত্তর পেলাম, তাতে ভ্যাবাচাকা খাওয়ার পালা আমার। দীপাবলি নাকি তিনদিন পুরো ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছেন। ধ্যাৎ। তাই আবার হয় নাকি? উত্তর এলো। হয় বন্ধু হয়। এ জগতে সবই হয়। কিন্তু তাই বলে তিনদিন কেউ ঘুমিয়ে থাকতে পারে নাকি? বুঝলাম। যাই হোক সেটা দীপাবলীর ব্যক্তিগত বিষয়। সেখানে আমার নাগ গলানো শোভন নয়। দীপাবলী সুস্থ রয়েছে, এটাই বড়ো কথা।
বন্ধু জানেন, আমি কত একা? হা হা। সে আর নতুন কথা কি। একা না হলে আর আমার সাথে মধ্যরাতের সংলাপে রাত কাবার করতে হয়। আমিও তো একা মানুষ। জগতে একা মানুষের সংখ্যাই তো বেশি। বললাম সে কথা। দীপাবলীর কাছ থেকে আগেই জেনেছি, তাদের দাম্পত্য টেকেনি বেশিদিন। কিন্তু কেন, জানতে চাইনি সেকথা। মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার আগ্রহের অভাব চিরকালই। আর তখনই দীপাবলীর প্রশ্ন ছুটে এলো। রিনিতাকে চেনেন? রিনিতা? রিনিতা রায়? হ্যাঁ চিনি তো। বললাম সেই কথা। আমার পত্রিকায় অনেকদিন ধরেই কবিতা পাঠায়। আপনার পরিচিত? জানতে চাইলাম আমি।
না, সেরকম নয়। তবে চিনি। কিন্তু আমি অবাক। হঠাৎ রিনির প্রসঙ্গ কেন? রিনিতা রায়ের সাথে আমার আলাপ খুব বেশি দিনের নয়। গত বছরেই ওর কবিতা চোখে পড়ে। বেশ ভালো লেখা। মাঝে মধ্যেই আমার পত্রিকায় লেখা পাঠায়। কখনো আমিই চেয়ে নিই। এই অব্দিই। অবশ্য এর বাইরেও একটু কথা আছে। রিনিতা স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে আরও বেশি করে কবিতাকেই আঁকড়িয়ে ধরেছে। তেমনটাই বলেছিল আমায়। গতবছর। একবার তো বইমেলায় দেখাও হলো। খুব সুন্দর কবিতা পাঠ করে। মঞ্চে উঠে মাইক্রোফনের সামনে রিনিতার স্বরচিত কবিতা শুনতে দর্শকের ভীড়ও কম হয় না।
অনেক্ষণ দীপাবলীর উত্তর নাই। নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলছে। এই এক বিরক্তিকর অবস্থা। যার উত্তরের অপেক্ষায়। তার উত্তর নাই। কিন্তু প্রোফাইলের পাশে সবুজ বাতি জ্বলছে। কতক্ষণ খেয়াল নাই। দীপাবলীর মেসেজ। বন্ধু কি ঘুমান নাকি? থাক ঘুমের খোঁজ নিয়ে আর কাজ নাই। বললাম না। এই তো আপনারই অপক্ষায়। হা হা আমার অপেক্ষায়? কন কি? অনেক সৌভাগ্য আমার। একটা উপকার করতে পারবেন বন্ধু? বলুন। কি করতে হবে। জানতে চাই আমি। দীপাবলীর ভরাট চোখদুটোর কথা ভাবতে ভাবতে। পরের মেসেজ এলো। সেদিন বললেন না, আপনার কোন ভাই পুলিশ দপ্তরের উচ্চপদে আছে? হ্যাঁ আছে তো। কিন্তু হঠাৎ পুলিশের খোঁজ কেন? একটু দরকার ছিল আর কি।
বলুন। জানেন আমার এক বন্ধুকে তার স্বামী পাগল সাজিয়ে বৌয়ের সব পৈতৃক সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় আছে। সেকি? কেন? সে অনেক কথা বন্ধু। আমি আপনাকে শুধু একটা ঠিকানা দেবো। সেটি আপনার পুলিশ ভাইকে দিয়ে বলবেন সেই ঠিকানায় গেলে তিনতলার চিলেকোঠায় উত্তরের দেওয়ালে একটা ভাঙা পুরানো গীটার ঝুলছে। ঝুলে ভরা। তার ভিতরে একটা ছোট খামে একটা মাইক্রোচিপ পাওয়া যাবে। আমি তো অবাক। এতো প্রায় রহস্য গল্পের মতো! কিন্তু এসব কাজ তো স্থানীয় থানার দায়িত্ব। আমার ভাই তো আর নিজে যাবে না। বললাম আমি। দীপাবলীর মেসেজ। না না প্লীজ প্লীজ। আপনার ভাইকে বলবেন তিনি নিজেও যেন উপস্থিত থাকেন। নয়তো পুলিশ সেই বান্ধবীর স্বামীর হয়ে কেসটা ধামাচাপা দিয়ে দেবে আবার।
এবার রীতিমত রহস্যের গন্ধ পেলাম আমি। চিরকাল রহস্যরোমাঞ্চ গল্পের পোকা। একসময় তো ডিটেকটিভ গল্পের লেখক হওয়ার স্বপ্নও দেখতাম কম নয়। কিন্তু দীপাবলীর কাছ থেকে আর কোন কথা জানা গেল না। আমিও জোর করলাম না। যাই হোক। আমাকে ভরসা করে একটা গুপ্ত কথা জানিয়েছেন। এবার আমার দায়িত্বটুকু পালন করতে হবে। দীপাবলীর মেসেজ থেকে তার বান্ধবীর ঠিকানা লিখে নিলাম চিরকুটে। কলকাতা থেকে বেশ একটি দূরের এক শহর। সেই রাতেই ভাইকে ফোনে ধরলাম। সংক্ষেপে সবটা বলে, আবারও মনে করিয়ে দিলাম। দীপাবলীর একান্ত অনুরোধটুকু। স্থানীয় থানার উপরে ভরসা না করার। বিষয়টা উপর মহল থেকে নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কিছু একটা বড়ো রহস্য রয়েছে। জড়িয়ে রয়েছে এক অসহায় নারীর জীবনের প্রশ্নও।
ঠিকা আছে দাদা। তুমি চিন্তা করো না। আমি সব খৌঁজ খবর নিচ্ছি। তুমি ঠিকানাটা আমাকে মেসেজ করে পাঠাও। তোমার অনুরোধ আমার কাছে আদেশ। যাক নিশ্চিন্ত হলাম আমি। এই ভাই ওর ছোটবেলায় আমার খুব ভক্ত ছিল। কোলে পিঠেই মানুষ প্রায়। সে যাক। ওর কথার দাম অশেষ। দীপাবলীর অনুরোধটুকু পুরণ করা দিয়ে কথা। সেটাই আসল। ওনার মেসেজে থেকে, ওঁর অনুরোধের ভিতর একটা ব্যাকুল প্রার্থনার সুর বেজে উঠে ছিল যেন।
দুই
দিন কয়েক পর। হঠাৎ ভাইয়ের ফোন। আমি বাড়িতে থাকবো কখন। বললাম সারাদিন বাড়িতেই আছি। তুই আসছিস? বলল না। একজন অফিসার আসবেন। কেন রে্ কি ব্যাপার্ আমার বাড়িতে পুলিশ কেন? এরপর ভাইয়ের উত্তর শুনে বেশ অবাকই হলাম। যিনি আসবেন, তাঁকে নাকি আমার ইনবক্সে দীপাবলীর সাথে কবে কোন তারিখে কি কথা হয়েছে, সব খুলে দেখাতে হবে। মানে? আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। সে সব আমার প্রাইভেট কথা। আমি পাবলিক করবো কেন? তারপর অচেনা অজানা অপরিচিত কোন পুলিশ অফিসারকে? না না। না রে। এমন অনুরোধ তুই আমাকে করিস না। এ আমার একান্ত প্রাইভেট বিষয়। এর সাথে আমার বান্ধবীর প্রাইভেসিও জড়িত। আমি কোন অবস্থাতেই সেটা নষ্ট হতে দিতে পারবো না। তুই আমার নিজের ভাই। তুই কি করে এমন কথা বলিস। বেশ একটু রেগেই উত্তর দিই আমি। ফোনের ওপারে কয় সেকেন্ড কোন কথা নাই। দেখ দাদা, আমি জানি আমি তোমাকে জোর করতে পারি না। আইনত। তোমার ফেসবুকের ইনবক্স দেখার কোন অধিকারও আমাদের নাই। অন্য কেউ হলে আমি এই অনুরোধ করতেও পারতাম না। না অফিসিয়ালি। না আনঅফিসিয়ালি। কিন্তু তুমি জানো। তুমি অনেক বিষয়ে আজও আমার আইডল। তাই একটা বিষয়ে নিশ্চিত হতেই, তুমি বলেই এই অনুরোধটা করছি। আমি নিজে যেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সেই উপায় নাই বলেই আমি খুবই বিশ্বস্ত সহকর্মীকে পাঠাচ্ছি। তোমার বান্ধবীর অনুরোধ পুরণ করতেই এটা আমায় করতে হচ্ছে দাদা।
বেশ। ঠিক আছে। কিন্তু এই কথা তো দীপাবলীকে ঘুণাক্ষরেও বলা যাবে না। ছি ছি। এ কোন লজ্জায় পড়লাম রে বাবা। আমার নিজের জন্য তত নয়। দীপাবলীর কথা আমি পাবলিকলি ওপেন করে দেবো? কিন্তু ওদিকে নিজের ভাইয়ের কথাও ফেলে দিতে পারি না। যথেষ্ঠ দায়িত্বপূর্ণ পদে দক্ষতার সাথে কাজ করছে। আমাকেও শ্রদ্ধা করে খুবই। অন্তত সে আমার অসম্মানের কারণ হবে না। এটুকু ভরসা আমার আছে। এদিকে আবার দিন কয়েক দিপাবলীর দেখা নাই। সারাদিনে যখনই ঢুকি। প্রোফাইলে সবুজ আলো নেভা। আমারও পত্রিকার কাজের ব্যস্ততা বেশি। সামনের সংখ্যা প্রকাশের তাড়া। মনের ভিতরে অস্বস্তি।
ছেলেটি বেশ সপ্রতিভ। একাই এসেছে। আসতেই ভাইয়ের ফোন। আমায় নিশ্চিত করলো। চিন্তার কিছু নাই। ওকে শুধু ইনবক্সটা একবার খুলে প্রথম যবে থেকে আলাপ, সেটাই দেখাতে হবে। তারিখটাই নাকি গুরুত্বপূর্ণ। তারিখ? প্রথম মেসেজের তারিখ? বেশ। অগত্যা লগইন করতেই হলো। পুলিশ অফিসারকে পাশে বসিয়ে। তাও মনের ভিতরে একটা অস্বস্তির খোঁচা। কি জানি দীপাবলী নতুন কোন মেসেজ দিয়ে রাখলে, অফিসারের চোখে তো পড়বে। অবশ্য দীপাবলীর মেসেজ খুবই শোভন সুন্দর বরাবর। কিন্তু একি? বিস্ময়ে হতবাক আমি। দীপাবলীর নামের ইনবক্স যে পুরো ফাঁকা! সেকি? সব মেসেজ ডিলিট করে দিয়েছেন? কিন্তু তাহলেও আমার মেসেজগুলি তো থাকবে অন্তত। আমি যতক্ষণ না ডিলিট করছি। সেগুলিও তো গায়েব! কি কাণ্ড! আমার বিস্ময় বাড়িয়ে তরুণ অফিসারটি সামান্য হাসলেন। মৃদু স্বরে বললেন। ঠিক আছে। আমার আর কিছু দেখার নাই। আপনি বন্ধ করে দিতে পারেন। কিন্তু আমি তো হতবাক! এই ক’দিনের এত এতো কথা। এতো এতো গানের কলি। সব উধাও? এ কি করে সম্ভব!
অসম্ভব নয়। হটাৎই বললেন অফিসারটি। শুধু জানতে চাইলেন আমার সাথে দীপাবলীর প্রথম আলাপের দিন থেকে কতদিন কেটেছে। আমার হিসাব মতো দিন দশেক মাত্র। জানালাম আমি। ও আচ্ছা। বলে ছেলেটি কাকে ফোনে ধরলো। আমার মেসেঞ্জারের সব ডাটা উধাও। সেই কথাই বলতে শুনলাম। কিছুক্ষণ বাদে ফোনালাপ শেষ হতে ছেলেটি বিদায় নিতে চাইল। বললো আমার ভাইয়ের সাথে বাকি কথা বলে নিতে। আমি তো ভেবে কোন কূলকিনারই পাচ্ছি না। অফিসার ছেলেটিকে এগিয়ে দিয়ে আমি আবার লগইন করে ঢুকি। দীপাবলী কোথায় যেতে পারে? প্রথমেই একটা মেসেজ পাঠালাম। দেখা নাই কেন কি হয়েছে। আমাদের সব কথা ডিলিট হলোই বা কি করে? এরপর অপেক্ষা। কখন দীপাবলীর প্রোফাইলে সবুজ আলো জ্বলে ওঠে। কিন্তু না। সময় গড়িয়ে চলে। আমার অস্থিরতা বাড়তে থাকে। অন্য সব কাজ পণ্ড। ইতিমধ্যে ভাইয়ের ফোন। জানালো পরশু আসছে আমার কাছে। তখন সব জানতে পারবো। আরও কিছু সময় লাগবে নাকি। কিন্তু রহস্যটা কি? দীপাবলীর সেই নাম না জানা বন্ধুটির সাথে আমাদের দুজনের মেসেজ উধাও হওয়ারই বা কি সম্পর্ক। কিছুই তো ঢুকছে না মাথায়।
পুরো দুই রাত জেগে। ঠায় লগইন করে বসে আছি। দীপাবলীর সবুজ প্রদীপ আর জ্বলে ওঠেনি। কি এমন হতে পারে? তবে কি ওর বান্ধবীর স্বামীর রোষানলে পড়ে অফলাইন হয়েছে। সেও নিশ্চয় ফেসবুকে। নজর রাখতে পারে দীপাবলীর উপরে। হয়তো নিজের আত্মরক্ষার কারণেই দীপাবলী অনলাইন হচ্ছেন না। তাই হবে। নাহলে তো অন্য কোন ব্যাখ্যাই আসছে না মাথায়। অন্তহীন অপেক্ষায় মানুষের ভিতরে সব যুক্তিবুদ্ধি ওলোট পালোট হয়ে যেতে থাকে। বুঝতে পারছি। আমারও সেই দশা। প্রায় সব কাজ পণ্ড। একেই কি বলে ভালোবাসা? আমি তো দীপাবলীর প্রেমে পড়তেই চেয়েছি। ইস। ফোন নংটাও যদি দিত। তাহলে আজ এই ভাবে অপেক্ষা করতে হতো না। কিন্তু ফোনেরও যদি সুইচ অফ থাকতো? থাকতেই পারে। হয়তো এখনই আছে। তাহলে দীপাবলীরও কি কোন বিপদ? বন্ধুর উপকার করতে গিয়ে না জানি কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো।
অধৈর্য্য হয়ে ভোররাতে ভাইকেই আবার ফোন করি। কিন্তু রিং বেজে গেল। ফোন ধরল না। হয়তো বেশি রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আহা ওদের কাজের যা চাপ। থাক বিশ্রাম নিক। আজই তো আসবে বলেছে আমার এখানে। অপেক্ষাই না হয় করি বরং আর একটু। মাঝে মাঝেই ওয়ালে উঁকি দিচ্ছি। ডেক্সটপ খোলা। না দীপাবলীর প্রোফাইলে কোন সবুজ প্রদীপ জ্বলছে না। কোথায় গেলেন ভদ্রমহিলা? কোন বিপদে পড়লেন? ভাই আসলেই এই বিষয়টা ওকে বোঝাতে হবে। ভদ্রমহিলার বান্ধবীর যাই হোক। দীপাবলীর যেন কোন ক্ষতি না হয়। সে যেন কোন বিপদে না পড়ে। ওকে এটা নিশ্চিত করতে বলবো।
জানি না কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অনেক বেলায় ঘুম ভাঙলো। ঘড়িতে বেলা বারোটা। হতেই পারে দুই রাত পুরো জেগে। পিসি কখন অফ হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি চালু করি। দীপাবলী কি কোন মেসেজ দিয়েছেন? নাহ। সেই যে কে সেই। মনটা সত্যই খারাপ হয়ে গেল। বুকের ভিতর হঠাৎ একটা হিমশীতল অনুভুতি। দীপাবলী যদি আর কোনদিন যোগাযোগ না করে? না না। তেমনটা হওয়ারই কথা নয়। আমাদের পত্রিকায় ওঁর একটা ধারাবাহিক আত্মজীবনীমূলক লেখা প্রকাশ করার বিষয়ে অনেকদূর কথা এগিয়ে রয়েছে। সামনের সংখ্যাতেই প্রথম কবিতা প্রকাশ হবে আমাদের পত্রিকায়। কোথায় চলে যাবেন দীপাবলী।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় ভাই এল। প্রথমেই আমার মুখের দিকে তাকালো। না এ চোখ কোন ভাইয়ের চোখ নয়। এ পুলিশের চোখ। এ চোখ আমি চিনি। চিনি আমার ভাইয়ের চোখও। দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। বললাম কি রে, ব্যাপারটা কি? আমাকে মাপতে বসলি কেন? আমার কথায় হেসে ফেল্ল ছেলে। পুলিশের চোখের ভিতর থেকে বেড়িয়ে পড়লো ভাইয়ের চোখ। শোন। তুমি যে ঠিকানাটা দিয়েছিল। তোমার বান্ধবীর বান্ধবীর বাড়ি বলে। বললাম হ্যাঁ। দীপাবলীর বান্ধবীর বাড়ির ঠিকানা। আমায় থামিয়ে দিয়ে ও বলে, না দাদা। ওটা দীপাবলী মিত্রের বাড়ি। মানে বাড়িটি ওই নামে রেজেস্ট্রি করা। সেকি? দীপাবলীর বাড়ী? তারই তিনতলার চিলেকোঠায়। হ্যাঁ দাদা। আমি নিজে গিয়েছিলাম। তুমি যেমন বলেছিলে। ঠিক তেমনই সেই ঝুলে ভরা পুরানো ভাঙাচোরা গীটারের ভিতরে ধুলো জমা একটা খামের ভিতর সেই মেমারিচীপটা পাওয়া যায়। যেটার জন্য অবশেষে কেসটা সলভ করা সম্ভব হলো। প্রায় তিন বছর পর। কেস? আমার বিস্ময়ের পারদ বাড়তেই থাকে।
দীপাবলী মিত্রের স্বামী একটি সরকারী ব্যাঙ্কের ম্যানেজার। সেই ব্যঙ্কেই হঠাৎ বদলি হয়ে আসেন রিনিতা রায়ের স্বামী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত একদিন অফিসে কর্মরত অবস্থায় তাঁর হার্টফেল হয়ে মৃত্যু হয়। তারপর থেকে রিনিতা রায়ের সাথে দীপাবলী মিত্রের স্বামীর আলাপ। ভদ্রমহিলার জন্য যতখানি করা সম্ভব সবই করেছিলেন ভদ্রলোক। তাঁর পদাধিকার বলে। সহকর্মীর দায়িত্ব থেকে। ফলে রিনিতা রায়ও ওনার প্রতি খুবই কৃতজ্ঞ ছিলেন। এই অব্দি সবই ঠিক ছিল। কিন্তু গোল বাঁধলো রিনিতা রায়ের সাথে দীপাবলী মিত্রের আলাপ করিয়ে দেওয়ার পর থেকেই। দীপাবলীর স্বামীর ধারণা ছিল, প্রায় সমবয়সী দীপাবলীর সাথে আলাপ হলে রিনিতা রায় একজন সমব্যাথী সাথী পাবেন। কিন্তু ফল হলো উল্টো। দুই জনেই সুন্দরী রূপসী। দুইজনের বিদ্যাশিক্ষাও সমান সমান। দুই জনেই পত্রপত্রিকায় অল্পবিস্তর লেখালেখি করেন। তাই দুইজনের ভিতরে একটা অন্তঃসলিল প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কে কাকে ছাপিয়ে যাবেন। সেখান থেকেই একটা ঈর্ষাজনিত অহঙ্কার দুইজনের ভিতরেই নাকি দেখা দেয়। দীপাবলীর দাম্পত্য সুখের পাশে স্বামীহারা রিনিতার বিষাদ ক্রমেই দীপাবলীর স্বামীর প্রতি তাঁকে আসক্ত করতে থাকে। উল্টো দিকে আপন স্বামীর উপরে সন্দেহ জন্মাতে থাকে দীপাবলী মিত্রের। রিনিতা তাদের কে হয়। যে তার জন্যে তাঁর স্বামীর এত উৎকন্ঠা। আসলে রিনিতার রায়ের জন্য একটা সরকারী চাকরীর খুব চেষ্টা শুরু করেছিলেন ভদ্রলোক। সেটা দীপাবলীর সন্দেহকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। ফলে একটা ত্রিকোণ টেনশনের সম্পর্ক জন্মাতে থাকে। এইটুকু বলে ভাই থামতে আমি অধৈর্য্য হয়ে উঠি। কিন্তু এতো রিনিতা রায় ও দীপাবলীর গল্প। কিন্তু সেই বান্ধবী। যাঁর স্বামী তাঁর বৌয়ের পৈতৃক সম্পত্তি হস্তগত করতে স্ত্রীকে পাগল প্রতিপন্ন করতে উঠে পড়ে লেগেছে! তাঁর কি হলো?
বলছি দাদা। ধৈর্য্য ধরে সবটা শোন। তাহলে তোমার সব উত্তরই পেয়ে যাবে। বেশ বেশ। বল শুনি। ভাই বলতে শুরু করে আবার। এই ভাবে কিছুদিন চলতে চলতে সত্যি সত্যিই রিনিতার মোহে পড়ে যান দীপাবলীর স্বামী। দীপাবলীর সন্দেহ ক্রমেই নাকি সত্যি হয়ে উঠতে থাকে। আর তখনই চাপ দিতে থাকেন রিনিতা রায়। ডিভোর্সের জন্য। তাঁর এক কথা। যে কোন একজনকে বেছে নিতে হবে। দীপাবলী থাকলে রিনিতাকে ভুলে যেতে হবে। রিনিতাকে পেতে গেলে ডিভোর্স করে বৌয়ের সম্মানে ঘরে নিয়ে আসতে হবে। খুবই যৌক্তিক দাবি। কিন্তু দীপাবলীর স্বামী জানেন স্ত্রীকে ডিভোর্স দিলে তাঁর আমও যাবে বস্তাও যাবে। মানে? জিজ্ঞাসা করি আমি। সামান্য হেসে ভাই বলে, দীপাবলী পৈতৃক সূত্রে বিপুল সম্পত্তির মালিক। এখন স্বামী হিসাবে সেই সম্পত্তির সবটাই তাঁর স্বামীই দেখাশোনা করেন। স্ত্রীকে ডিভোর্স দিলে গোটা সম্পত্তিটাই হাতছাড়া হয়ে যাবে। আবার বৌ খোরপোষ চাইলে তাও দিতে হতে পারে। ফলে রিনিতাকে বিয়ে করলে ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের আর্থিক ক্ষতি অনেক। এদিকে রিনিতাকে ছেড়ে দীপাবলীকে নিয়েও আর থাকতে ভালো লাগছে না। রিনিতার তুলনায় দীপাবলীর স্বাদ পুরানো হয়ে গিয়েছে। শরীর মন নতুন একটা ভুমি চাইতে শুরু করে দিয়েছে।
এই রকম অবস্থাতেই সম্ভবত দীপাবলীর স্বামীর মাথায় একটা প্ল্যান আসে। যদি কোন ভাবে দীপাবলীকে পাগল প্রতিপন্ন করা যায়, তবে সমস্ত সম্পত্তির দখলও নিজের কাছে রাখা যাবে। আর স্ত্রীকে পাগলা গারদে পুরে দিয়ে রিনিতাকে নিয়েই বাকি জীবন কাটানো যাবে। আর ইতিমধ্যে দীপাবলীর যদি মৃত্যু হয় তো কথাই নাই। সোনায় সোহাগা। অন্তত ততদিন রিনিতা নিশ্চয় অপেক্ষা করতে পারবে। বিয়ে না হোক সহবাসে তো আর কোন বাধা থাকবে না। এবং প্ল্যানটা ঠিকমতো কার্যকরি করতে পারলে, অন্য কোন শহরে বদলি নিয়ে চলে গেলে লোকসমাজের অস্বস্তিও আর থাকবে না। আমি তো হতভম্ব! তার মানে অন্য কোন বান্ধবীর গল্প নয়? এটা দীপাবলীর নিজের জীবনের ঘটনা? অথচ আমাকে কিছুই টের পেতে দেয় নি। উল্টে বানিয়ে কাল্পনিক বন্ধুর নামে চালিয়ে দিয়েছে? কি আশ্চর্য্য! কিন্তু কেন? আমি দীপাবলীকে বন্ধু বলেই বরণ করেছি মনে মনে। সেকথা তাঁর জানা নাই তাও না। হ্যাঁ আমি কখনো নিজে থেকে তাঁর সম্বন্ধে কোন কথা জানতে চাইনি। যা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের প্রাইভেট কথা। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু নিজের কথা বন্ধুর নামে বানিয়ে বলে চালানো কেন। আসুক একবার অন লাইনে। এখানেই আমার লেগেছে বেশি। তারমানে আমার ওপর দীপাবলীর কোন নির্ভতাই নাই!
তারপর কি হলো শুনি। বল তো। আবার বলতে শুরু করে ভাই। রিনিতাকে এই প্রস্তাব যখন দেন দীপাবলীর স্বামী। তখন গোটা কথোপথন, যাতে দীপাবলীর স্বামীর কথাই বেশি, রিনিতা রেকর্ড করে রাখে তার ফোনে। রেকর্ড মানে ভিডিও রেকর্ডিং। নিভৃত আলাপের দুর্বল মূহুর্তে দীপাবলীর স্বামী টের পান নি ব্যাপারটা। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে তিনি যতই চিন্তা করতে থাকেন, ততই গড়াতে থাকে দিন। লোভ আর ভয় এই দুইয়ের ভিতর সম্ভবত দুলতে থাকেন তিনি। মানে আমাদের কাছে তিনি যে বয়ান দিয়েছেন। বয়ান দিয়েছেন? অবাক হই আমি। হ্যাঁ তিনি এখন পুলিশ কাস্টডিতে। তোরা তাঁকে গ্রেফতার করেছিস? লাফিয়ে উঠি আমি। তবে তোরা নিশ্চয় জানিস দীপাবলী কোথায়? আজ পরপর একটানা কদিন অনলাইনে আসেননি তিনি। আমাকে শান্ত হতে বলে, ভাই বলে সব বলবো বলেই তো তোমার কাছে এলাম। একটু ধৈর্য্য ধরে শোন। হ্যাঁ। ধৈর্য্য ধরেই তো রয়েছি। কখন ওর প্রোফাইলের পাশে আবার সবুজ প্রদীপ জ্বলবে বলে। অনেক কথা জমে যাচ্ছে। সেসব বলতে হবে তো।
যা বলছিলাম। ভাই বলে চলে। দীপাবলীর স্বামীর ভিতর এই দোলাচলে অস্থির হয়ে ওঠেন রিনিতা। তাঁরও তখন একটা অধিকার বোধ জন্মিয়ে গিয়েছে। অনেকটা সান্নিধ্য সময় ও আবেগ দিয়ে ফেলেছেন নতুন এই সম্পর্কে। তার সাথে দীপাবলীকে টেক্কা দেওয়ার বিষয়টাও রয়েছে। আর তখনই ব্ল্যাকমেল করা শুরু করেন রিনিতা। দীপাবলীর স্বামী এইটা কল্পনা করতেও পারেন নি। রেকর্ড করে রাখা ভিডিওটা ফরোয়ার্ড করে দেন রিনিতা রায়। মাথায় বজ্রপাত দীপাবলীর স্বামীর। বুঝতে পারেন নিজের দুর্বলতায় নিজের দোষেই ঘোর বিপাকে পড়ে গিয়েছেন তিনি। এর থেকে মুক্তির একটিই উপায় নিজেরই প্ল্যান তাড়াতাড়ি কার্যকর করে তোলা। রিনিতা রায়ের এক ভাই নাকি নামী একটি মানসিক আরগ্য নিকেতনের চিকিৎসক। রিনিতাই প্রস্তাবটা দেন। সেই ভাইয়ের সাহয্য নিয়েই দিনে দিনে দীপাবলীকে মানসিক রুগী প্রতিপন্ন করতে দেরী হবে না খুব একটা। সেইমতোই কাজ এগোতে থাকে। এমনিতেই এই টানাপোড়েনে দীপাবলীর হাই ব্লাডপ্রেসার দেখা দেয়। সন্দেহবাতিক আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে। রিনিতা রায় ইচ্ছে করেই দীপাবলীর মনে ঈর্ষার জ্বলন বাড়িয়ে দিতে প্রকাশ্যেই তাঁর স্বামীর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে তোলেন। ফলে যা হবার। ঘটনা সেই দিকেই গড়াতে থাকে। দিনে দিনে দীপাবলী প্রায় কোনঠাসা হয়ে পড়তে পড়তে মানসিক ভাবে বিদ্ধস্ত হতে থাকেন। আর তখনই ডিভোর্সের জন্য চাপ দিতে থাকেন তাঁর স্বামীও। কিন্তু নিজের অধিকার থেকে একচুলও সরতে রাজি হন না দীপাবলী। ফলে রিনিতাদের পরিকল্পনা মতো কাজ আরও সহজে এগোতে থাকে। এবং এই ষড়যন্ত্রে সামিল হন রিনিতার সেই চিকিৎসক ভাইও। কিন্তু ইতিমধ্য একটি কাণ্ড ঘটে। কোনভাবে দীপাবলী একদিন স্বামীর ফোনের নাগাল পেয়ে যান। এবং সেখানে সেই ব্ল্যকমেল করার ভিডিওটি দেখতে পেয়ে যান। উপস্থিত বুদ্ধিতে তিনি সাথে সাথে মেমারি চীপটা খুলে নিয়ে লুকিয়ে ফেলেন। যাক। কিছুটা হাঁফ ছাড়ি আমি। তাহলে চিলেকোঠার ঘরে ভাঙ্গা গীটারের ভিতরে খামের ভিতরে মেমারিচীপ ওঁরই রাখা। হ্যাঁ। ঠিক তাই। সমর্থনে ঘাড় নাড়ে ভাই।
আর এই ঘটনা ধরা পড়ে যেতেই হিংস্র হয়ে ওঠে ষড়যন্ত্রকারীরা। দীপাবলীর কাছ থেকে সব কেড়ে নেওয়া হয়। একটি বদ্ধ ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আটকে রাখা হয়। কাজও হয় তাড়াতাড়ি। ভয়ে আতঙ্কে দীপাবলীর কথাবর্তায় অসংলগ্নতা ধরা পড়তে থাকে। আর সেই সুযোগেই ওরা ওনাকে রিনিতার ভাই যে মানিসক আরগ্যনিকেতনটি চালান, তাতেই ভর্তি করে দেয়। এই হোল ঘটনা।
না, আমি প্রায় আঁতকে উঠি। দীপাবলীর কোন মানসিক রোগ নাই। এই কদিনে আমি যে মানুষটির সাথে রাতের পর রাত এত কথা এত গল্প করেছি, সে কখনোই মানসিক ভাবে অসুস্থ নয়। হতেই পারে না। তোদের কোথাও ভুল হচ্ছে। ভালো করে তদন্ত কর আরও। আমাকে আস্তে করে সোফায় বসিয়ে দেয় ভাই। না দাদা। আমরা এই কয়দিনে গোটা ঘটনাটা বিভিন্ম দিক দিয়েই তদন্ত করে দেখেছি। আর তোমার দেওয়া ঠিকানা থেকে সেই গীটার থেকে উদ্ধার করা রেকর্ডিং দেখাতেই দীপাবলীর স্বামী এবং রিনিতা রায় ও তাঁর চিকিৎসক ভাই সব দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন। আর তাঁদের নিজেদের কৃতকর্মের দায় স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া কোন পথও খোলা ছিল না দাদা। আমি তোমার অনুরোধেই তো গোটা তদন্তটা নিজের তদারকিতে আমাদের বেস্ট অফিসারদেরকে কাজে লাগিয়ে সম্পন্ন করেছি। তাছাড়া ওরা তিনজনই এখন আমাদের কাস্টডিতে।
আমি অনেক্ষণ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। দীপাবলীর সব কথা ওর খালি গলার সেই গান আমার কানে বাজতে থাকে। সেই মেয়ে মানসিক আরোগ্য নিকেতনে চিকিৎসাধীন। না না এ হতে পারে না। ও সম্পূর্ণ সুস্থ। আমি বলছি তোকে শোন দীপাবলী সম্পূর্ণ সুস্থ মস্থিষ্কের একজন মানুষ। ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে বলি। আমি এই কয়দিনে তার সাথে অনেক কথা বলেছি জানিস। কত ধরণের বিষয় নিয়ে আমাদের আলাপ আলোচনা হয়েছে। তোকে সব দেখাতে পারতাম। সে যদি সব ডিলিট করে না দিত। তাহলেই তুই বুঝতে পারতিস। সে মানসিক ভাবে কতটা সুস্থ মনের একজন মানুষ। বেশ তো আমার কথা বিশ্বাস না হয়। আমায় নিয়ে চল সেই আরোগ্য নিকেতনে। আমি তার সাথে তোর আলাপ করিয়ে দেবো। তোর এতদিনের পুলিশে চাকরির অভিজ্ঞতা। তুই টের পাবি না তাই হয়। তার সাথে আলাপ হলেই তুই বুঝতে পারবি। কত গভীর তার মন। আর কি সুন্দর গুছিয়ে কথা বলে। জানিস, এত সুন্দর গান গায় না রে। একেবারে খালি গলায়।
তুই আজি আমায় নিয়ে চল। বলেই আমি পোশাক বদলাতে এগোই। কিন্তু ভাই আমায় থামিয়ে দেয়। আবার সোফায় বসিয়ে বলে। দাদা আমি তোমার কথা এতটুকু অবিশ্বাস করছি না। তুমি একটু শান্ত হয়ে বসো। আমি বুঝতে পারছি তোমার ভিতরে ওনার জন্য একটা কষ্ট হচ্ছে। যেকোন মানুষেরই হবে। এইরকম একটা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে একজন মানুষ সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলে কি হয়, সেটা বুঝতে তো বেশি দেরী হওয়ার কথাও নয়। আর আমাদের এই পেশায়, এই ঘটনাও নতুন কিছু নয় জানো। অনেক পরিবারেই এই রকম ঘটনার ঊনিশবিশ রকম ফের দেখা যায়। কিন্তু রহস্যটা সেখানে নয় দাদা।
রহস্য? আর কি রহস্য। আর যাই রহস্য থাকুক না কেন, তুই আমার সাথে চল। আমায় নিয়ে সেখানে। যেখানে দীপাবলী রয়েছে। তোর সব রহস্য পরিস্কার হয়ে যাবে। আমার কথায় ভাই একটু অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, সেখানে আর যাওয়া যাবে না দাদা। সময় পেড়িয়ে গিয়েছে। সময় পেড়িয়ে গিয়েছে মানে? কটা বাজে। সবে তো রাত আটটা। আর তুই তো যাবি তদন্তের স্বার্থে। তোর সেই অধিকারও রয়েছে। শুধু সাথে আমিও থাকবো। তোর সেই পদাধিকার আছে। আমি জানি।
না দাদা কথা সেটা নয়। সেটা নয়্ আমি অবাক হই আবারো। কোনটা কথা তবে শুনি? আর তুই দীপাবলীর সাথে দেখা করতে চাইছিস নাই বা কেন? তোর তদন্তের স্বার্থেই তো আরও বেশি করে দেখা করতে হবে। আর যেহেতু সে আমার বন্ধু। আমার মাধ্যমেই তোরা এতবড়ো একটা ষড়যন্ত্র ধরতে পেরেছিস। তাই আমিও তোদের তদন্তের একজন সহযোগী তো। না কি?
দাদা দীপাবলী সেই আরগ্যনিকতনে আর নাই। নাই? মানে কোথায় চলে গিয়েছে সে? সেখানে না গেলে আমরা খুঁজবোই বা তাঁকে কি করে? আর তুই চুপ করে বসে আছিস? এবার আমি সত্যই অধৈর্য্য হয়ে উঠি। আর ঠিক তখনই ভাই একটা কাগজ আমার হাতে দেয়। একটি জেরক্স কপি। আমি হতভম্ভ হয়ে বসে থাকি। দীপাবলীর ডেথ সার্টিফিকেটর একটি জেরক্স।
অনেকক্ষণ কোন কথা জোগায় না আমার মুখে। ভাইয়ের দিকে তাকাই। ভাই বলে, দাদা ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর তারিখটা দেখো। আমি প্রায় সম্মোহিতের মতো ভাইয়ের নির্দেশ অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি। মৃত্যুর তারিখের জায়গায় লেখা আছে তেরোই জুলাই আর সালের জায়গায়, ঠিক এক বছর আগের সাল। অসম্ভব এ হতে পারে না। এ জাল সার্টিফিকেট। তুই নিজে তদন্ত ভার হাতে নে। নয়তো তোদের যা সব অপদার্থ স্টাফ।
না দাদা। আমি নিজের হাতেই বিষয়টা তদন্ত করে তবেই তোমার কাছে এসেছি। দীপাবলী মিত্র, ঐ তারিখেই আরোগ্যনিকেতনের চার তলার ব্যালকোনি থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। একেবারে স্পটডেড। রিনিতা রায় আর দীপাবলীর স্বামী গত মাসেই বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন।
কি বলছিস তুই? হ্যাঁ দাদা। আর আমরা ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি, গত তিন বছরে দীপাবলী মিত্রের একাউন্টে এক বারের জন্যেও কেউ লগইন করে নি। কেউ লগইন করে নি? ওরে তাহলে সেই ঠিকানা আমি তোকে দিলাম কি করে?
সেটাই তো দাদা। শুধু এই একটি জায়গাতেই আমাদের তদন্ত আটকিয়ে গিয়েছে। আমি তোমাকে জানি তাই। আমি অন্য ভাবে ম্যানেজ করেছি। নয়তো তোমাকে নিয়েও আদালতে টানাটানি হতো। কি করে পেলে তুমি এই সব তথ্য। যেখানে দীপাবলী মিত্র আত্মহত্যা করেন একবছর আগেই।
এক বছর! এক বছর আগেই আত্মহত্যা করেছে দীপা? কি বলছিস তোরা আমাকে? আমি যে কদিন আগেও ওর সাথে কথা বললাম। সারারাত। আরও কত কথা জমে আছে জানিস তুই। এইসবও তো বলতে হবে না কি? আমাকে তবে রোজ অপেক্ষা করতে হবে। কবে দীপার প্রোফাইলে সবুজ প্রদীপ জ্বলে উঠবে আবার। এবার আর ছাড়বো না। জোর করে ওর মোবাইল নম্বর জেনে নেবো। মোবাইল নম্বরটা আমায় যদি দিত এখনই ওর সাথে তোর কথা বলিয়ে দিতাম। তাহলেই দেখতিস। তোর সব রহস্য পরিস্কার হয়ে যেতো। যাক চিন্তা করিস না। আজ হোক কাল হোক। দীপা একবার অনলাইন হলেই আমি ওর ফোন নম্বরটা জেনে নিয়ে তোকে ম্যাসেজ করে দেবো। না আর আমি অফলাইন হবো না। কখন যে মেয়ে এসে আমাকে না দেখতে পেয়ে ভাববে, আমি ওকে ভুলে গিয়েছি। সেটা হতে দেওয়া যাবে না। দেখিই না কখন সবুজ প্রদীপ জ্বলে ওঠে। আর একটু অপেক্ষা করি বরং।